সফল বাংলাদেশ

সফল বাংলাদেশ: সব সফলতার খবর আলোচনা হোক গর্বের সাথে

উন্মুক্ত হলো সমুদ্র সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার

চালু করুন এপ্রিল 27, 2012

উন্মুক্ত হলো সমুদ্র সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার নিজস্ব প্রতিবেদকহামবুর্গের আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে গতকাল বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হলো সমুদ্রসম্পদের এক বিশাল ভাণ্ডার। এর ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নিবিড় অর্থনৈতিক অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিকার পেল। এর বাইরেও মহীসোপানের উল্লেখযোগ্য অংশে সম্পদ আহরণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। মিয়ানমারের সঙ্গে পূর্বদিকের সীমানা বিরোধ মিটে যাওয়ায় বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারবে। এ ছাড়া অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ আহরণের সম্ভাবনাও রয়েছে।
নৌবাহিনীতে কাজ করার সময় থেকেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন নিয়ে গবেষণা করেছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম। বর্তমানে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে আনক্লজ অনুবিভাগের দায়িত্বে আছেন। চূড়ান্ত রায় শোনার জন্য হামবুর্গ যাওয়ার আগে গত সপ্তাহে কালের কণ্ঠের কাছে জোরালো আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করছি ন্যায্যতার ভিত্তিতেই সমাধান পাব। ভৌগোলিক কারণেই সমদূরত্বের তত্ত্ব আমাদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না। আমরা এ বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরোধ নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছি।’ আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের (বাংলাদেশের) ভৌগোলিক অবস্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ১৯৬৭ সালে ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি করেছে জার্মানি। তাহলে আমরা কেন পাব না?’
সমদূরত্ব নয়, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমুদ্র-সীমানা মিটিয়েছে গিনি-গিনি বিসাউ, ডমিনিকা, ব্রুনাই-মালয়েশিয়াসহ আরো অনেক দেশ। তারা সমুদ্রের ভেতর ২০০ নটিক্যাল মাইলের অধিকার পেয়েছে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশও তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
গতকাল আন্তর্জাতিক আদালতের রায় বাংলাদেশের পক্ষেই এসেছে। হামবুর্গ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যা চেয়েছিল তার চেয়েও বেশি পেয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে ন্যায্যতার ভিত্তিতে দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভের ক্ষেত্রগুলো আগেই চিহ্নিত করে রেখেছিলেন খুরশেদ আলম। তাঁর মতে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা তীর থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরও মহীসোপানের আরো ২৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ দাবি নিয়েই হামবুর্গের ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ল অব দ্য সি’তে গেছে বাংলাদেশ। এ দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে এক বিস্তৃত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এঙ্ক্লুসিভ ইকনোমিক জোন) ও মহীসোপানের (কন্টিনেন্টাল শেল্ফ) একচ্ছত্র অধিকার পাবে বাংলাদেশ। উন্মুক্ত হবে সমুদ্রসম্পদের এক বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার। তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ নিতে পারবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
খুরশেদ আলম জানান, বিপুল মৎস্যসম্পদ, তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে রয়েছে কোবাল্ট সালফাইড, নুডল্স, যা থেকে কোবাল্ট, নিকেল, ম্যাগনেসিয়াম, তামার মতো দামি খনিজ পদার্থ আহরণ করা সম্ভব। পাপুয়া নিউগিনিসহ বেশ কয়েকটি দেশে নুডল্স থেকে কিছু পরিমাণ স্বর্ণও পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত না থাকায় বহুজাতিক খনি উন্নয়ন (মাইন ডেভেলপমেন্ট) কম্পানিগুলো অনুসন্ধানকাজে আগ্রহী হচ্ছে না। মিয়ানমারের সঙ্গে পূর্বদিকের সীমা নির্ধারিত হয়ে গেলে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে থাকবে। দুই বছর পর ভারতের সঙ্গে পশ্চিম দিকের সীমা ঠিক হয়ে গেলে বাংলাদেশ সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারবে। তখন বিদেশি কম্পানিগুলোও নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসবে।
খুরশেদ আলম বলেন, সমুদ্রসীমা রক্ষা ও সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশে সমুদ্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন জরুরি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিতেও ওশেনোলজি পড়ানো হয় না। ফলে আমাদের এখানে সমুদ্রবিদ্যায় কোনো লোকবল নেই। অথচ ভারতে অন্তত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়টি পড়ানো হয়।
তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমুদ্রবিজ্ঞানের চার বছর মেয়াদি কোর্স চালু করতে রাজি হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হওয়ার কথা। এর ফলে আগামী কয়েক বছরে দেশে সমুদ্রতত্ত্বের কিছু জনবল তৈরি হবে বলে আশা করছেন খুরশেদ আলম।
ভারত ও মিয়ানমারের দাবি, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সীমা নির্ধারণ হোক। এ হিসাবে বাংলাদেশ পেত মাত্র ১৩০ নটিক্যাল মাইল। সমুদ্রে যে ২৮টি গ্যাস ব্লকের রূপরেখা রয়েছে, তার ১৭টিই দাবি করে মিয়নমার, ১০টির দাবি ভারতের। বাংলাদেশের হাতে থাকে কেবল একটি, যেখানে এখন কনোকো-ফিলিপ্স অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সীমানা নির্ধারণের আগে এ ধরনের গ্যাস ব্লকের পক্ষে দাবি জোরালো হয় না বলে জানিয়েছিলেন খুরশেদ আলম। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে বাংলাদেশের দাবি জোরালো হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে সীমা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলোর তাগিদ না থাকায় সেই উদ্যোগ গত চার দশকেও সম্পন্ন হয়নি। এ নিস্পৃহতার সুযোগে প্রতিবেশী দেশগুলো আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছে। এতে ন্যায্য সমুদ্রসীমা থেকে বাংলাদেশের বঞ্চিত হওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গত বছর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছে তার যৌক্তিক জলসীমার দাবি পেশ করেছে।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় সংসদে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট’ আইন পাস করেছিল তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার। এ ধরনের আইনের কথা তখন ভারত বা মিয়ানমার চিন্তাও করেনি। দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক আলোচনাও শুরু হয়েছিল তখন থেকে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা নিয়ে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছিল, পরবর্তী সরকারগুলো তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেশীদের চেয়ে অনেক আগে উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে মিয়ানমার ও ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। তারা নিজেদের মধ্যেও আন্দামান সাগরে সীমা নির্ধারণের সমঝোতায় পেঁৗছেছে।
১৯৭৪-এর পর থেকে প্রায় দুই দশক পর্যন্ত সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। মাঝখানে ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ প্রণীত আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। নিয়ম অনুযায়ী দেশে সেটিকে অনুস্বাক্ষর (রেটিফাই) করা দরকার থাকলেও দীর্ঘ ১৯ বছরে তা হয়নি। সে কাজটি করা হয়েছে ২০০১ সালে। এর ১০ বছরের মধ্যে মহীসোপানের দাবি জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করার কথা। সময়সীমা ছিল ২০১১ সাল। তার আগে ভূতাত্তি্বক (সেইসমিক) ও বেথিমেট্রিক জরিপ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। ২০১০ সালে এ দুটি জরিপ শেষ করে সময়সীমা পার হওয়ার আট মাস আগেই বাংলাদেশ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তার দাবি পেশ করেছে। খুরশেদ আলম মনে করেন, ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিবেচনা করলে বাংলাদেশ সমুদ্রতীর থেকে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৪৬০ নটিক্যাল মাইল (৮৫২ কি. মি.) পর্যন্ত পাওয়ার দাবি রাখে। সমুদ্রের এ এলাকা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকেও আয়তনে বড়। এ দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশ বিশাল সমুদ্রসম্পদের অধিকার পাবে। পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের (পূর্বে মিয়ানমার ও পশ্চিমে ভারত) সঙ্গে চার দশকেও সমুদ্রসীমা সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় বাংলাদেশ সমুদ্রের তলদেশে তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ আহরণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারছে না।


সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন, সম্পাদক : ইমদাদুল হক মিলন, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের পক্ষে মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন কর্তৃক প্লট-৩৭১/এ, ব্লক-ডি, বসুন্ধরা, বারিধারা থেকে প্রকাশিত এবং প্লট-সি/৫২, ব্লক-কে, বসুন্ধরা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, ঢাকা-১২২৯ থেকে মুদ্রিত।
বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ : বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, প্লট-৩৭১/এ, ব্লক-ডি, বারিধারা, ঢাকা-১২২৯। পিএবিএক্স : ০২৮৪০২৩৭২-৭৫, ফ্যাক্স : ৮৪০২৩৬৮-৯, বিজ্ঞাপন ফোন : ৮১৫৮০১২, ৮৪০২০৪৮, বিজ্ঞাপন ফ্যাক্স : ৮১৫৮৮৬২, ৮৪০২০৪৭। E-mail : info@kalerkantho.com

সুত্র


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: