২৯ এপ্রিল ২০১২
কাওসার রহমান ॥ টানা পঞ্চমবারের মতো দেশে বোরোর বাম্পার ফলনের রেকর্ড সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় চলতি বছরও দেশে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। কিন্তু এ বাম্পার ফলনের পর কৃষকরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ধানের মূল্য নিয়ে। বোরো ধান কাটা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে নতুন ধানের বাজারে ধস নামার। ইতোমধ্যে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ধানের দাম আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে কৃষকের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। অথচ সার, বিদ্যুত, ডিজেল ও কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এ বছর বোরো উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকার ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসছে না। বরং বিপুল মজুদ নিয়ে সরকারও এবার বোরো ধান-চাল ক্রয়ের ব্যাপারে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। গত দুই বছর আগে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হলেও এবার এখন পর্যন্ত বোরো ধান- চাল সংগ্রহের মূল্য ঘোষণা করা হয়নি। ফলে নতুন ধানের বাজার নৈরাশ্যজনক অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে। এ সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা নতুন ধানের বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারাই এখন বোরো ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ অবস্থায় সরকার ধানের বাজারে হস্তক্ষেন না করলে কৃষক ধান আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে সারাদেশে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। দেশের হাওড় অঞ্চলে এখন পুরোদমে ধান কাটা চলছে। অন্যান্য অঞ্চলেও আগাম বোরো ধান কাটা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৩০ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। কৃষক নগদ টাকার জন্য বাজারে নতুন ধান নিয়ে গিয়ে বিপাকে পড়ছে। নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ধানের বাজারও পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ভিজা ধান প্রতিমণ ৪৫০ থেকে ৫শ’ টাকায় নেমে এসেছে। হাওড় অঞ্চলে নতুন ভিজা ধানের দাম ৪শ’ টাকায় চলে এসেছে। ফলে কৃষকের মধ্যে দারুণ হাতাশা দেখা দিয়েছে।
এবার নিয়ে টানা পাঁচ বছর দেশে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, বড় ধরনের কোন প্রাকৃতি দুর্যোগ না হওয়ায় এ বছর বোরোর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ধানের যে ফলন দেখা যাচ্ছে তাতে বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত ধানের ফলন পাওয়া যাচ্ছে। এতে এ বছর বোরোর উৎপাদন এক কোটি ৯০ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের দক্ষতার কারণে গত পাঁচ বছর ধরেই দেশে বোরোর বাম্পার ফলন সম্ভব হয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে বোরোর এ বাম্পার ফলন শুরু হয়েছে। ওই বছর চাল আকারে বোরোর উৎপাদন আগের বছরের এক কোটি ৫০ লাখ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এক কোটি ৭৭ লাখ ৬২ হাজার টনে দাঁড়ায়। পরের বছর ২০০৮-০৯ সালে বোরো উৎপাদন হয় এক কোটি ৭৮ লাখ নয় হাজার টন। পরবর্তীতে নন-ইউরিয়া সারের মূল্য হ্রাস করার কারণে কৃষক তার জমিতে সুষম সার প্রয়োগের সুযোগ পায়। সেই সঙ্গে অন্যতম কৃষি উপকরণ সার কৃষকের দোরগোড়ায় চলে যাওয়ায় বোরো উৎপাদনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে ২০০৯-১০ সালে বোরো উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৮৩ লাখ ৪১ হাজার টন। পরের বছর ২০১০-১১ সালে বোরো উৎপাদন আরও বেড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ টন হয়। ধারাবাহিকভাবে টানা পাঁচ বছর বোরোর এ বাম্পার ফলন দেশে কৃষি খাতের ইতিহাসে একটি অনন্য রেকর্ড, যার কৃতিত্ব এ দেশের কৃষকদের।
কিন্তু এ বাম্পার ফলন নিয়েও কৃষক খুশি হতে পারছে না। বাজারে ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় নতুন ধান নিয়ে কৃষকের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ইউরিয়া সার, ডিজেল, বিদ্যুত ও কৃষি মজুরের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর বোরো উৎপাদনের খরচ কমপক্ষে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর যেখানে এক কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৫ টাকা ৪৭ পয়সা, এ বছর সেখানে খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ১৩ পয়সা।
গত বছর নতুন ধান ওঠার পর ধানের দাম যেখানে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকার মধ্যে ছিল। এ বছর তা ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ১৭-১৮ টাকা উৎপাদন খরচের বিপরীতে কৃষক এবার ধানের দাম পাচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা। নগদ টাকার সঙ্কটের কারণে এ দামেই কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন ফড়িয়াদের কাছে ধান বেচতে।
নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ধানের দাম কমে যাওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে বোরো ধান কাটা পুরোদমে শুরু হলে এ দাম আরও কমে যাবে। ফলে কৃষক তার ধান নিয়ে বিপাকে পড়বে। বিশেষ করে সবচেয়ে বিপদে পড়বে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা। কারণ নগদ টাকার সঙ্কটের কারণে তাদেরই নতুন ধান নিয়ে এখন বাজারে দৌড়াতে হচ্ছে।
নতুন ধানের বাজারে এ নৈরাশ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি হলেও সরকার এখন পর্যন্ত ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করেনি। বিপুল পরিমাণ মজুদের কারণে সরকার এবার ধান-চাল সংগ্রহে ধীরগতিতে এগুচ্ছে, যা বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে সরকারের কাছে প্রায় ১৩ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে ১১ লাখ টনই চাল। এ মজুদ নিয়ে সরকার এবার কতটা ধান-চাল কিনতে পারবে সেটা নিয়েও সরকার চিন্তায় আছে। কারণ সরকারী খাদ্য গুদামগুলোর ধারণক্ষমতা ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন।
এ অবস্থায় খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক একটি চ্যানেলকে জানিয়েছেন, এ বছর দেশে প্রায় দুই কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সরকার দশ লাখ টন চাল কিনে কতটা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কৃষক এবার বোরো ধানের ভাল দাম পাবে কিনা এ নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। কারণ সরকার চাইলেও বোরো ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তবে এ বিষয়ে সরকার কি করতে পারে তা নির্ধারণে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হবে।
তিনি বলেন, ‘সরকার ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যে দেশে চাল আমদানি বন্ধের চিন্তাভাবনা করছে। সেই সঙ্গে সরু চাল রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
মন্তব্য করুন