সফল বাংলাদেশ

সফল বাংলাদেশ: সব সফলতার খবর আলোচনা হোক গর্বের সাথে

বসুন্ধরা সিটির সফল নির্মাণ বাংলাদেশের স্থপতিদের সামর্থ্যের বড় প্রমাণ

চালু করুন এপ্রিল 20, 2012

 স্থপতি মুস্তফা খালিদ পলাশ। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শপিংমল বসুন্ধরা সিটির স্থপতি তিনি। শুধু ঢাকা শহরেই অন্তত এক ডজন শীর্ষ স্থাপনার নাম বলা যাবে, যা মুস্তফা খালিদের নকশায় তৈরি হয়েছে। তিনি শুধু স্থপতিই নন, একজন গুণী চিত্রশিল্পীও। 
মুস্তফা খালিদ বাংলাদেশ আর্কিটেক্টস ইনস্টিটিউট, আমেরিকান আর্কিটেক্টস ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্সের সদস্য। এ ছাড়াও স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, জার্নাল এবং মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত তিনি। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ঢাকা নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসেফিক ঢাকায় ক্লাস নেন। 
বার্জার অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন আর্কিটেকচার ২০০৭, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর গ্রামীণফোন করপোরেট বিল্ডিং প্রোজেক্ট ২০০৫, ফোকাস কান্ট্রিস আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার ২০০৩ ভারত, আই এবি ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৮সহ আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মুস্তফা খালিদ। এক শিল্পী পরিবারে মুস্তফা খালিদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা মরহুম কেএমজি মুস্তফা ছিলেন বাংলাদেশ কুটিরশিল্প করপোরেশনের চিফ ডিজাইনার, মা শিল্পী আফরোজা মুস্তফা। একমাত্র ভাই দেশের বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তফা। সহধর্মিণী স্থপতি সাজিয়া ইসলাম, দুই ছেলে নৈঋত ও ইশান। 
স্থপতি মুস্তফা খালিদ বর্তমানে ভিসতেরা গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি ঘর বাড়ির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত্কারে  বলেছেন বসুন্ধরা সিটি সৃষ্টির সেই কাহিনী। সাক্ষাত্কারটি নিয়েছেন আবদুল আলীম
ঘর বাড়ি : আপনি তো ভালো ছবি আঁকেন। চিত্রশিল্পী না হয়ে স্থপতি হলেন কেন? 
মুস্তফা খালিদ : আমি আসলে শিল্পী পরিবারের সন্তান। আমার বাবা-মা দুজনেই শিল্পী। শিল্পী পরিবারে বড় হয়েছি। ভাবনায়ও ছিল আমি শিল্পী হব। ছোটবেলা থেকেই আমি ছবি আঁকতাম। স্কাউটিং করতাম। সংগঠন করতাম। এসবের প্রতি আমার যথেষ্ট ঝোঁক ছিল। কিন্তু একসময় দেখলাম শিল্পী হলে অনেক কষ্ট। আমার বাবাকে দেখতাম অনেক কষ্টে জীবন চালাতেন। বুঝলাম শিল্পীজীবনে আর্থিক সচ্ছলতা আসবে না। তখনই ভাবতে শুরু করলাম- কী করলে শিল্পীও বেঁচে থাকবে, আবার আর্থিক অনটনও হবে না। আমার কাছে মনে হলো স্থাপত্য এমন একটা শিল্প যার মধ্যে সবকিছুই আছে। এর মধ্যে চিত্রকলা আছে, ভাস্কর্য আছে। সুখ আছে, দুঃখও আছে। তখনই ভাবলাম আর্কিটেক্ট হব। ওই সময়ে আমি সেভেন-এইটে পড়ি। ছাত্র হিসেবে বরাবরই ভালো ছিলাম। একসময় বুয়েটে স্থাপত্য বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলাম। তারপর স্থপতি হয়ে গেলাম। 
ঘর বাড়ি : কর্মজীবনের শুরু সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুস্তফা খালিদ : পাঁচ বছরের কোর্স শেষ হলো সাত বছরে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে পাস করে বের হলাম। রেজাল্ট প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি একটু স্বাধীনচেতা। ফলে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই কিছু করব। প্রথম পাঁচ বছর আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেছি, প্রচুর কষ্ট করেছি। কিন্তু ভালো কিছু করতে পরিনি। বরং আর্থিক ও মানসিক দিক দিয়ে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। পরে বাবা মারা যাওয়ার পর ভাবলাম আমার একটা স্থায়ী উপার্জন না থাকলে চলছে না। বাধ্য হয়ে বুয়েটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলাম। এটি ছিল ১৯৯৪ সাল। পাশাপাশি ছোটখাটো কাজও চালিয়ে যাই।
ঘর বাড়ি : বসুন্ধরা সিটির কাজটা কবে কীভাবে শুরু করলেন? 
মুস্তফা খালিদ: ১৯৯৮ সাল। আমি তখনও বুয়েটেই অধ্যাপনা করছি আর বাইরে কিছু কিছু কাজ করছি। এর মধ্যেই হঠাত্ আমার কাছে একটি কাজ আসে। আমি যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে কাজটি শুরু করি। দিনরাত পরিশ্রম করি এই কাজটা নিয়ে। ব্যাপারটা একরকম সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যাই। এখানে বলা দরকার, এই কাজটা করার সময় আরেক সহকর্মী মো. ফয়জুল্লাহ আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। প্রতি মুহূর্তে চুলচেরা বিশ্লেষণ, পরিশ্রম, প্রতি মুহূর্তের টেনশন আর উত্তেজনা চলতে থাকে আমাদের এ কাজ ঘিরেই। এক পর্যায়ে নিজের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস চলে আসে। ওই বছরই আমি বুয়েটের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে এই কাজে মনোযোগ দিই। এভাবেই এক পর্যায়ে কাজটি সম্পন্ন হয়। এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলের চালু সবচাইতে বড় অত্যাধুনিক শপিংমল বসুন্ধরা সিটি। 
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমরা প্রতিষ্ঠা করি ভিসতেরা আর্কিটেক্ট। একে একে নকশা করেছি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় ভবনের। 
ঘর বাড়ি : বসুন্ধরা সিটি দেখে আপনার কখনও কি মনে হয় -এখানে আরও কিছু করার সুযোগ ছিল?
মুস্তফা খালিদ : না। তেমন কিছু মনে হয় না। তবে এখন মনে হয় যে সামনে ছোট ছোট দোকানগুলো না হলেই হয়তো ভালো হতো। এরপরও বলব স্থাপত্য তো একটি শিল্প। আর স্থপতি একজন শিল্পী। সেটা যদি মানেন তাহলে তো আপনাকে মানতেই হবে শিল্পীর হূদয় সব সময়ই অতৃপ্ত। 
ঘর বাড়ি : বসুন্ধরা সিটি’র নিরাপত্তা নিয়ে বলুন। 
মুস্তফা খালিদ : বসুন্ধরা সিটি কিন্তু অত্যন্ত নিরাপদ একটি ভবন। এর ডিজাইন এমনভাবে করা যে এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। যদিও বসুন্ধরা সিটিতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, কয়েকটি মূল্যবান প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের সুউচ্চ ভবনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে তা হয়নি। এর অন্যতম কারণ হলো এর ডিজাইন। এ ভবনটি অত্যন্ত নিরাপদ বলেই এই দুর্ঘটনার পরও এর স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে কোনো প্রভাব পড়েনি।
ঘর বাড়ি : বসুন্ধরা সিটি উপমহাদেশের বৃহত্ শপিংমল, আপনার প্রথম সফল বড় কাজ। এই বৃহত্ সফল কাজের অনুভূতি এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? 
মুস্তফা খালিদ : বসুন্ধরা সিটি সার্থকভাবে সম্পন্ন করার পর আমি এবং আমরা ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছি, যা পরে আমাদের আরও ভালো কাজ করার দায়িত্বটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু আমাদের নয়, নিঃসন্দেহে বসুন্ধরা সিটির সফল নির্মাণ বাংলাদেশের স্থপতিদের সামর্থ্যের বড় প্রমাণ।
বসুন্ধরা সিটির ব্যাপারটা হচ্ছে, আসলে সে সময় একটা গিমিক দরকার ছিল। পরিবর্তনের একটা ধারা তৈরি হওয়া দরকার ছিল। মানুষকে নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা চমক দেওয়া দরকার ছিল। আমাদের দেশে সে চমকটা ছিল না। আন্তর্জাতিক মানের একটা শপিংমল আমাদের ছিল না। কারণ এর নির্মাণে ঝুঁকিও ছিল। এত বিশাল বিনিয়োগের ঝুঁকিটাই কেউ নিতে চায়নি। বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ সে ঝুঁকিটা নিয়েছে এবং সফল হয়েছে। যে শূন্যতা ছিল, বসুন্ধরা সিটির মধ্য দিয়ে তা পূরণ হয়েছে। এটার দরকার ছিল। কিন্তু সহজ ছিল না মোটেই। তবে তা অসম্ভবও যে ছিল না এর প্রমাণ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমানের বসুন্ধরা সিটি।
ঘর বাড়ি : দেশের যত সুউচ্চ ভবন এর প্রায় সবগুলোই বিগত দুই দশকে হয়েছে। নতুন স্থপতিদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? 
মুস্তফা খালিদ : বাংলাদেশের স্থাপত্যের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। ষাটের দশকে এর যাত্রা শুরু হলেও এটি কিন্তু ডালপালা মেলেছে নব্বইয়ের দশকে এসে। এখানে অনেক বড় একটি পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করেছে ডেভেলপাররা। তাদের বাণিজ্যের কারণেই প্রয়োজন দেখা দেয় বেশি স্পেস ব্যবহার করার। এ কারণে প্রয়োজন দেখা দেয় নিখুঁত প্ল্যানের। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে যে এত বেশি বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে যে এখানে আর পরিবেশের এবং মানসিক বিকাশের ভারসাম্য থাকছে না। ফলে প্রয়োজন হলো বিল্ডিং কোডের। সেটাও হলো। গত দুই দশকে বাংলাদেশে আমরা এই সেক্টরে কমার্শিয়াল হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। আগামী প্রজন্মের জন্য বলতে পারেন একটি উদাহরণ তৈরি হয়েছে। কারণ একটি হাইরাইজ বিল্ডিং একটি মেশিনের মতো। এর ক্ষয়ক্ষতি দানবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অতএব এ ধরনের ভবন তৈরিতে অনেক বেশি সাবধানতা এবং অনেক বেশি নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করতে হয়। এ ধরনের ভবন নির্মাণের জন্য নকশা তৈরিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির দরকার, যা ইদানীং আমাদের দেশে কিছু কিছু পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যখন প্রথমদিকে কাজ করেছি এগুলোর যথেষ্ট অভাব ছিল। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। তারপরও অনেক আন্তর্জাতিক মানের ভবন হয়েছে। আমি মনে করি আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আগামী প্রজন্ম আমাদের তৈরি করা ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আরও অনেক বড় ও ভালো কাজ করবে বলেই আমার বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা। 
ঘর বাড়ি: আপনি একজন স্থপতি ও একজন চিত্রশিল্পী। এই দুটোকে কীভাবে সমন্বয় করেন?
মুস্তফা খালিদ : একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে আমি স্বাধীন, এখানে আমার মনের ক্যানভাসে যা খুশি আঁকতে পারি। স্থাপত্যে সে স্বাধীনতা নেই। এখানে আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়, মানুষের, পরিবেশের, মালিকের, ভবনের-সবার স্বার্থ দেখতে হয়। আঁকাটা আমি সব সময়েই উপভোগ করি।

সুত্র


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

%d bloggers like this: